ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (কেরানীগঞ্জ) সূর্যমুখী ভবনের একটি সাধারণ কক্ষ। বন্দী হিসেবে সেখানে ছিলেন সাইদুর রহমান সুজন (৪৫)। রোববার (১৫ জুন) সকালে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
ঘটনাটি ঘটেছে সকাল ১১টার দিকে। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে কারাগারের হাসপাতালে নেয়া হয়, পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রথমে এটি নিছক একটি আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়— কিভাবে একজন ‘ডিটেন্যু’ বন্দি সাধারণ কক্ষে আত্মহত্যা করলেন? গামছার মতো একটি সাধারণ সামগ্রী কীভাবে হয়ে উঠলো মৃত্যুর হাতিয়ার?
জানা গেছে, সুজন ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ মোট ১৫টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এসব মামলা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় তিনি ছিলেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে কারা সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
কিন্তু এখানেই প্রশ্ন—এই ধরনের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (high-profile) একজন বন্দিকে কেন সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে একই কক্ষে রাখা হলো? এবং কেন কোনো মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ বা নিয়মিত মনোবিদ পরামর্শের ব্যবস্থা ছিল না?
বাংলাদেশের কারা ব্যবস্থায় বন্দীদের আত্মহত্যার ঘটনা নতুন নয়। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে অন্তত ২৮ জন বন্দী কারাগারে আত্মহত্যা করেছেন। এর বেশিরভাগেরই পেছনে রয়েছে মানসিক চাপ, দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া এবং কারাগারের অনুপযুক্ত মানবিক পরিবেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিটেন্যুদের জন্য আলাদা মানসিক সহায়তা বা বিশেষ নজরদারি থাকা উচিত। কারণ তারা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে আটক থাকেন এবং তাঁদের ওপর মানসিক চাপ অনেক বেশি থাকে।
সূর্যমুখী ভবনের নাম শুনলে বোঝায় আলোর প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে সেই ভবন কি বন্দীদের জন্য আশ্রয় না এক ধরণের একাকিত্বের কারাগার? সুজন যে কক্ষে ছিলেন, তা কি ছিল পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের আওতায়? সিসিটিভি ফুটেজ কি বলছে? আত্মহত্যার আগেই কি কোনো সংকেত ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হবে।
সুজনের মৃত্যু কি সত্যিই আত্মহত্যা? নাকি এটি ছিল এক অব্যক্ত প্রতিবাদ—দীর্ঘদিন আটকে থাকা বিচারপ্রক্রিয়ার, কারাগারের মানসিক নির্যাতনের কিংবা জীবনযাপনের অসহ্য বাস্তবতার বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত অভিব্যক্তি?
এটি কেবল একজন বন্দির মৃত্যু নয়—এটি দেশের কারা ব্যবস্থার নীরব দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। আত্মহত্যার এই খবর যতক্ষণ না আমাদের নীতিনির্ধারক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নাড়িয়ে দেয়, ততক্ষণ এসব মৃত্যুই রয়ে যাবে নীরব পরিসংখ্যান হিসেবে।