Dhaka 12:27 am, Friday, 13 June 2025

“আমি ফিরে এসেছি” এক কিশোরীর গল্প

 

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। বিকেলটা ছিল একেবারে সাদামাটা। পরীক্ষার ভয় মাথায়, প্রাইভেট শেষে ফিরছিলাম বরিশালের দক্ষিণ আলেকান্দা দিয়ে। চারপাশে ফেব্রুয়ারির স্নিগ্ধ রোদ ছড়িয়ে ছিল, নিস্পাপ একটা বিকেল। অথচ জানতাম না, সেই আলো-ছায়ার আড়ালে আমার জন্য লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকার।

আরমান খান সড়কের মাথায়, সুমনের ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ে এক তরুণ—জনি সরদার। চেহারায় অপরিচিত, নামটাও তখনো জানতাম না। বয়সে একটু বড় হবে, বিশের কাছাকাছি। কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত চেনা ভাব, যেন আমাকে আগেই চিনে রেখেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার বাহু শক্ত করে ধরে। সঙ্গে আরও দুজন ছিল। আমি কথা বলার আগেই গলা আটকে আসে, শরীর থমকে যায়। কিছুই করার আগেই আমাকে তুলে ফেলা হয় একটি সিএনজিতে।

সেই মুহূর্তে আমি বুঝি—সবকিছু বদলে গেছে।
তারপরের দিনগুলো যেন একটা দুঃস্বপ্ন—ভয়, নির্যাতন আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই আটকে ছিলাম। কোথায় ছিলাম, কার কাছে ছিলাম, তা বোঝার উপায় ছিল না।

শুধু প্রতিরাতে চোখ বন্ধ করলেই মনে হতো—আমার বাবা নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছে। মনে হতো, আর কোনোদিন হয়তো তার মুখ দেখতে পাব না।
পরে জেনেছি, বাবা কোতোয়ালি থানায় অপহরণের মামলা করেছিলেন। পুলিশও খুঁজেছে, কিন্তু পথ সহজ ছিল না। অবশেষে সেই মামলা গিয়েছে র‍্যাব-১০ এর হাতে। আমি জানতাম না তখন, কেউ নীরবে, নিঃশব্দে আমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য লড়ছে।

১০ জুন ২০২৫, বিকেল সাড়ে তিনটা। দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কালীগঞ্জ বাজারে ভিড়ের মধ্যে ধরা পড়ে জনি সরদার। র‍্যাব-১০ এর নিখুঁত নজরদারি, প্রযুক্তির ব্যবহার—সব মিলিয়ে অবশেষে আমাকে খুঁজে পাওয়া যায়।

আমি এখনো থরথর করে কাঁপি ভিতরে ভিতরে। আমি ভেঙে গিয়েছি, তবু ভেঙে পড়িনি। ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই ভয়কে পেছনে ফেলে আবার বেঁচে থাকার সাহস জেগেছে।

এখন শুরু হচ্ছে নতুন এক অধ্যায়—নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, ভেতরের ভাঙা অংশগুলোকে জোড়া লাগানোর সংগ্রাম। জনি সরদারের জন্য অপেক্ষা করছে আইন ও বিচার। আর আমার সামনে খুলে যাচ্ছে এক নতুন জানালা—নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার, আবার স্বপ্ন দেখার।

আমি জানি না সামনে কী আছে। কিন্তু এটুকু জানি—আমি একা ছিলাম না। কেউ না কেউ লড়ে গেছে আমার জন্য, দাঁড়িয়ে থেকেছে নীরবে।
তাই আজ, সাহস করে বলতে পারি—
“আমি ফিরে এসেছি।”

 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

“আমি ফিরে এসেছি” এক কিশোরীর গল্প

“আমি ফিরে এসেছি” এক কিশোরীর গল্প

Update Time : 05:13:38 am, Wednesday, 11 June 2025

 

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। বিকেলটা ছিল একেবারে সাদামাটা। পরীক্ষার ভয় মাথায়, প্রাইভেট শেষে ফিরছিলাম বরিশালের দক্ষিণ আলেকান্দা দিয়ে। চারপাশে ফেব্রুয়ারির স্নিগ্ধ রোদ ছড়িয়ে ছিল, নিস্পাপ একটা বিকেল। অথচ জানতাম না, সেই আলো-ছায়ার আড়ালে আমার জন্য লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকার।

আরমান খান সড়কের মাথায়, সুমনের ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ে এক তরুণ—জনি সরদার। চেহারায় অপরিচিত, নামটাও তখনো জানতাম না। বয়সে একটু বড় হবে, বিশের কাছাকাছি। কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত চেনা ভাব, যেন আমাকে আগেই চিনে রেখেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার বাহু শক্ত করে ধরে। সঙ্গে আরও দুজন ছিল। আমি কথা বলার আগেই গলা আটকে আসে, শরীর থমকে যায়। কিছুই করার আগেই আমাকে তুলে ফেলা হয় একটি সিএনজিতে।

সেই মুহূর্তে আমি বুঝি—সবকিছু বদলে গেছে।
তারপরের দিনগুলো যেন একটা দুঃস্বপ্ন—ভয়, নির্যাতন আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই আটকে ছিলাম। কোথায় ছিলাম, কার কাছে ছিলাম, তা বোঝার উপায় ছিল না।

শুধু প্রতিরাতে চোখ বন্ধ করলেই মনে হতো—আমার বাবা নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছে। মনে হতো, আর কোনোদিন হয়তো তার মুখ দেখতে পাব না।
পরে জেনেছি, বাবা কোতোয়ালি থানায় অপহরণের মামলা করেছিলেন। পুলিশও খুঁজেছে, কিন্তু পথ সহজ ছিল না। অবশেষে সেই মামলা গিয়েছে র‍্যাব-১০ এর হাতে। আমি জানতাম না তখন, কেউ নীরবে, নিঃশব্দে আমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য লড়ছে।

১০ জুন ২০২৫, বিকেল সাড়ে তিনটা। দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কালীগঞ্জ বাজারে ভিড়ের মধ্যে ধরা পড়ে জনি সরদার। র‍্যাব-১০ এর নিখুঁত নজরদারি, প্রযুক্তির ব্যবহার—সব মিলিয়ে অবশেষে আমাকে খুঁজে পাওয়া যায়।

আমি এখনো থরথর করে কাঁপি ভিতরে ভিতরে। আমি ভেঙে গিয়েছি, তবু ভেঙে পড়িনি। ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই ভয়কে পেছনে ফেলে আবার বেঁচে থাকার সাহস জেগেছে।

এখন শুরু হচ্ছে নতুন এক অধ্যায়—নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, ভেতরের ভাঙা অংশগুলোকে জোড়া লাগানোর সংগ্রাম। জনি সরদারের জন্য অপেক্ষা করছে আইন ও বিচার। আর আমার সামনে খুলে যাচ্ছে এক নতুন জানালা—নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার, আবার স্বপ্ন দেখার।

আমি জানি না সামনে কী আছে। কিন্তু এটুকু জানি—আমি একা ছিলাম না। কেউ না কেউ লড়ে গেছে আমার জন্য, দাঁড়িয়ে থেকেছে নীরবে।
তাই আজ, সাহস করে বলতে পারি—
“আমি ফিরে এসেছি।”